আমার পথ | কাজী নজরুল ইসলাম
আমার পথ লিখেছেন কাজী নজরুল ইসলাম।
আমার কর্ণধার আমি। আমার পথ দেখাবে আমার সত্য। আমার যাত্রা-শুরুর আগে আমি সালাম জানাচ্ছি। নমস্কার করছি আমার সত্যকে। যে-পথ আমার সত্যের বিরোধী, সে পথ আর কোনো পথই আমার বিপথ নয়। রাজভয়-লোকভয় কোনো ভয়ই আমার বিপথে নিয়ে যাবে না। আমি যদি সত্যি করে আমর সত্যকে চিনে থাকি, আমার অন্তরে মিথ্যার ভয় না থাকে, তাহলে বাইরের কোনো ভয়ই আমর কিছু করতে পারবে না। যার ভিতরে ভয়, সেই বাইরে ভয় পায়। অতএব যে মিথ্যাকে চেনে, সে মিছামিছি তাকে ভয়ও করে না। যার মনে মিথ্যা, সেই মিথ্যাকে ভয় করে। নিজেকে চিনলে মানুষের মনে আপনা-আপনি এত বড় একটা জোর আসে যে সে আপন সত্য ছাড়া আর কাউকে কুর্নিশ করে না- অর্থাৎ কেউ তাকে ভয় দেখিয়ে পদানত রাখতে পারে না। এই যে, নিজে চেনা, আপনার সত্যকে আপনার গুরু, পদপ্রদর্শক কান্ডারি বলে জানা, এটা দম্ভ নয়, অহংকার নয়। এটা আত্নকে চেনার সহজ স্বীকারোক্তি। আর যদিও এটাকে কেউ ভুল করে অহংকার বলে মনে করেন, তবু এটা মন্দের ভালো-অর্থাৎ মিথ্যা বিনয়ের চেয়ে অনেক বেশি ভালো। অনেক সময় খুব বেশি বিনয় দেখাতে গিয়ে নিজের সত্যকে অস্বীকার করে ফেলা হয়। ওতে মানুষকে ক্রমেই ছোট করে ফেলে, মাথা নিচু করে আনে। ও রকম বিনয়ের চেয়ে অহংকারের পৌরুষ অনেক-অনেক ভালো। অতএব এই অভিশাপ-রথের সারথির স্পষ্ট কথা বলাটাকে কেউ যেন অহংকার বা স্পর্ধা বলে ভুল না করেন। স্পষ্ট কথা বলার একটা অবিনয় নশ্চিয় থাকে; কিন্তু তাতে কষ্ট পাওয়াটা দুর্বলতা। নিজকে চিনলে, নিজের সত্যকেই নিজের কর্ণধার মনে জানলে নিজের শক্তির ওপর অটুট বিশ্বাস আসে। এই স্বাবলম্বন, এই নিজের ওপর অটুট বিশ্বাস করতেই শেখাচ্ছিলেন, মহাত্মা গান্ধীজি। কিন্তু আমরা তাঁর কথা বুঝলাম না, “আমি আছি” এই কথা না বলে সবাই বলতে লাগলাম “গান্ধীজি আছেন”। এই পরাবলম্বনই আমাদের নিষ্ক্রিয় করে ফেললে। একে বলে সবচেয়ে বড় দাসত্ব। অন্তরে যাদের এত গোলামির ভাব, তারা বাইরের গোলামি থেকে অন্য একজন মহাপুরুষকে প্রাণপণ ভক্তি করলেই যদি দেশ উদ্ধার হয়ে যেত, তাহলে এই দেশে এতদিন পরাধীন থাকত না। আত্নকে চেনা নিজের সত্যকে বড় মনে করার দম্ভ-আর যাই হোক ভণ্ডামি নয়। এ দম্ভ শির উঁচু করে, পুরুষ করে, মনে একটা ‘ডোন্ট কেয়ার’-ভাব আনে। আর যাদের এই তথাকথিত দম্ভ আছে, শুধু তারাই অসাধ্য সাধন করতে পারবে। যার ভিত্তি পচে গেছে, তাকে একদম উপড়ে ফেলে নতুন করে ভিত্তি না গাঁথলে তার ওপর ইমারত যতবার খাড়া করা যাবে, ততবারই তা পড়ে যাবে। দেশের শত্রু, দেশের যা-কিছু মিথ্যা, ভণ্ডামি, মেকি তা সব দূর করতে প্রয়োজন হবে আগুনের সম্মার্জনা! আমার এমন গুরু কেউ নেই, যার খাতিরে সে আগুন সত্যকে অস্বীকার করে করুক মিথ্যা বা ভণ্ডামিকে প্রশ্রয় দেবে। আমি সে দাসত্ব হতে সম্পূর্ণ মুক্ত। আমি কোনো দিনই কারু র বাণীকে বেদবাক্য বলে মেনে নেব না, যদি তার সত্যতা প্রাণে তার সাড়া না দেয়। না বুঝে বোঝার ভণ্ডামি করে পাঁচ জনের শ্রদ্ধা গআর প্রশংসা পাবার লোব আমি কোনো দিনই করবা না। ভুলের মধ্য দিয়ে গিয়েই তবে সত্যকে পাওয়া যায়। কোনো ভুল করছি বুঝতে পারলেই আমি প্রাণ খুলে তা স্বীকার করে নেব। কিন্তু না বুঝেও নয়, ভয়ে নয়। ভুল করছি বা করেছি বুঝেও শুধু জেদের খাতিরে বা গোঁ বজায় রাখবার জন্যে ভুলটাকে ধরে থাকব না। তাহলে আমার আগুন সেই দিনই নিভে যাবে। একমাত্র মিথ্যার জলই এই শিখাকে নিভাতে পারবে। তাছাড়া কেউ নিভাতে পারবে না। . মানুষ ধর্মই সবচেয়ে বড় ধর্ম। হিন্দু-মুসলমানের মিলনের অন্তরায় বা ফাকি কোনোখানে তা দেখিয়ে দিয়ে এর গলদ দূর করা আমার এ পথের অন্যতম উদ্দেশ্য। মানুষ যেখানে প্রাণের মিল, আদত সত্যের মিল, সেখানে ধর্মের বৈষম্য, কোনো হিংসার দুশমনির ভাব আনে না। যার নিজের ধর্মের বিশ্বাস আছে যে, নিজের ধর্মকে সত্যকে চিনেছে, সে কখনো অন্য ধর্মকে ঘৃণা করতে পারে না। দেশের পক্ষে যা মঙ্গলকর বা সত্য, শুধু তাই লক্ষ করে এই আগুণের ঝান্ডা দুলিয়ে বাহির হলাম্।
No comments