আহ্বান | বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়
আহ্বান | বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়
-আমার তো তেনার নাম করতেন নেই বাবা। করাতের কাজ করতেন। বললাম তো তোমার ছেলে আছে? কেউ নেই বাবা, কেউ নেই। এক নাম জামাই আছে তো সে মোরে ভাত দেয় না। আমার বড্ড কষ্ট। ভাত জোটে না সবদিন। ব্যাপারটা এখানে চুকে যাবে ভেবেছিলাম। কিন্তু তা চুকল না। পরের দিন সকালে ঘুম থেকে উঠেছি, এমন সময় সেই বুড়ি লাঠি ঠক্ঠক্ করতে করতে হাজির উঠোনে। থাকি এক জ্ঞাতি খুড়োর বাড়ি। তিনি বললেন, ও হলো জমির করাতির স্ত্রী। অনেকদিন আগে মরে গিয়েছে জমির। বুড়ি উঠোনে দাঁড়িয়ে ডাকল, ও বাবা। বোধহয় একটু চোখে কম দেখে। বললাম, এইযে এখানে। আমার খুড়োমশায় বুড়িকে বুঝিয়ে দিলেন আমি কে। সে উঠোনের কাঁঠালতলায় বসে আপন মনে খুব খানিকটা বকে গেল।পরদিন কলকাতা চলে গেলাম, ছুটি ফুরিয়ে গেল। কয়েক মাস পরে জ্যৈষ্ঠ মাসে গরমের ছুটিতে আমার নতুন তৈরি খড়ের ঘরখানাতে এসে উঠলাম। কলকাতাতে কর্মব্যস্ত ক’মাসের মধ্যে বুড়িকে একবারও মনে পড়েনি বা এখানে এসেও মনে হঠাৎ হয়ত হতো না, যদি সে তার পরের দিন সকালে আমার ঘরের নিচু দাওয়ায় এসে না বসে পড়ত। বললাম, কী বুড়ি, ভালো আছো? ময়লা ছেঁড়া কাপড়ের প্রান্ত থেকে গোটাকতক আম খুলে আমার সামনে মাটিতে রেখে বলল, আমার কি মরণ আছে রে বাবা। জিজ্ঞাসা করলমা, ও আম কীসের। দন্তহীন মুখে একটু হাসবার চেষ্টা করে বললে, অ গোপাল আমার, তোর জন্যি নিয়ে আলাম। গাছের আম বেশ কড়া মিষ্টি, খেয়ে দেখ এখন। বড় ভালো লাগল। গ্রামে অনেকদিন থেকে আপনার জন কেউ নেই। একটা ঘনিষ্ট আদরের সম্বোধন করার লোকের দেখা পাই নি বাল্যকালে মা-পিসিমা মারা যাওয়ার পর থেকে। বুড়ি বললে, খাও কোথায় হ্যাঁ বাবা? খুড়ো মশায়ের বাড়ি। বেশ যত্ন করে তো ওনারা? তা করে। দুধ পাচ্ছ ভালো? ঘুঁটি গোয়ালিনী, দেয় মন্দ না। ও বাবা, ওর দুধ! অর্ধেক জল-দুধ খেতি পাচ্চ না ভালো সে বুঝেচি।পরদিন সকাল হয়েছে, বুড়ি দেখি উঠোনে এসে ডাকছে, অ গোপাল। বিছানা ছেড়ে উঠে বললাম, আরে এত সকালে কী মনে করে। হাতে কী? বৃদ্ধা হাতের নড়ি আমার দাওয়ার গায়ে ঠেস দিয়ে রেখে বলল, এক ঘটি দুধ আনলাম তোর জন্যি। সে কী! দুধ পেলে কোথায় এত সকালে? আমার মা বলে ডাকে ওই হাজরা ব্যাটার বউ। মোর চালাঘরের পাশে ওর চালাঘর। ওরে কাল রাত্তিরে বলে রেখে দিয়েছিলাম, বলি বউ আমার, গোপাল দুধ খেতি পায় না। তাই আজ ভোরে উঠে দেখি আমারে ডাকচে, মা ওঠো, তোমার গোপালের জন্যি দুধ নিয়ে যাও।আচ্ছা কেন বলতো তোমার এসব! আর কখনও এনো না। কত পয়সা দাম দিতে হবে বল। কতটা দুধ? বুড়ি একটু ঘাবড়ে গেল। ভয়ে ভয়ে বলে, কেন বাবা পয়সা কেন? পয়সা না তো তুমি দুধ পাবে কোথায়? ওই যে, বললাম বাবা, আমার মেয়ের বাড়ি থেকে। তা হোক, তুমি পয়সা নিয়ে যায়। সেও তো গরিব লোক। বুড়ি পয়সা নিয়ে চলে গেল বটে কিন্তু সে যে দমে গিয়েছি তার কথাবার্তার ধরছিলাম সেই মধ্যবয়সী স্ত্রীলোকটি। আমায় দেখে সলজ্জভাবে মাথার কাপড়টা আর একটু টেনে দেবার চেষ্টা করে সে বললে, বাবু কবে এসেছেন?-দিন পাঁচ-ছয় হলো। কেন? আামার সেই মা পেটিয়ে দিলে, বলে দেখে এসো গিয়ে। কেন? ও সেই বুড়ি-এখানে যিনি আসত।কর মিয়া আমায় দেখে বলল, এই যে বাবা, এসো। বুড়ির মাটি দেওয়ার দিন তুমি কনে থেকে এলে, তুমি তো জানতে না? তোমায় যে বড্ড ভালোবাসত বুড়ি। দুজন জোয়ান ছেলে কবর খুড়ছে। কবর দেওয়ার পর সকলে এক এক কোদাল মাটি দিল কবরের উপর। শুকুর মিঞা বলল, দ্যাও বাবা-তুমি দ্যাও। দিলাম এক কোদাল মাটি। সঙ্গে সঙ্গে মনে হলো, ও বেঁচে থাকলে বলে উঠতো, ও মোর গোপাল MD Ujjol Hossen
No comments